প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়।
নূরীর সাথে খোকনকে দেখে তালুকদার সাহেবের চোখ একটু ছোট হয়ে গেল। ছেলেটা না জানি মেয়েটার কান ভারী করে ফেলছে। উনি তাড়াতাড়ি বলে উঠেন নূরী তোমার আম্মাকে খাবার দিতে বল, আমরা খেয়েই বেরুব। লিচুকে ডাকতে পাঠাও।
ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল লিচু এল না। নূরীর আম্মা অনেক যত্ন করে রান্না করেছেন। জামাইএর খাওয়া নিয়ে নিয়ম মেনে চলতে হয়, তা তিনি জানেন। জাভেদের জন্য আলাদা তরকারি করে দিয়েছেন লবন ছাড়া। খাওয়া শেষ করে খোকন জাভেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যায়, তার খুব দরকারি কাজ আছে। রাতে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়।
লিচুর জন্য নূরীর দুশ্চিন্তা শুরু হয়। তবে কি নয়নের সাথে ওদের বাড়ি চলে গেল! কাজের ছেলেটা ফিরে এল। ভাইজান পরে আইব। হের খুদা নাই। নূরী বসে বসে সবার কাজ করা দেখে। নিজের সংসারের কথা মনে হয়। একটু অস্হির হয়ে যায়, কবে ফিরবে কে জানে। যে ভয় ঢুকে গেছে, সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। বসে থেকেই নূরীর চোখ ধরে এল, হঠাৎ কানে বাজে, মা উঠো না, আমি খাব।
চোখ মেলে দেখে লিচু দাঁড়িয়ে আছে, সাথে নয়ন। কি রে এত দেরি, সবাই খেয়ে উঠল, তোর দেখাই নাই। কোথায় গেলি যে খাওয়ার কথা মনে নাই!
মা জানো নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল। চল এবার তোমাকে নিয়ে যাব। আগে খেয়ে নেই।
খেতে বসে লিচু নয়নের সাথে ফিস ফিস করে, যেটা নূরীর চোখ এড়ায় না। কি রে হঠাৎ করে কি বলছিস!
মা জান, এখান থেকে অনেকেই ঢাকায় যাবে কাল, পরশুদিন বিরাট মিটিং হবে।
তা দিয়ে আমাদের কি বাবা। এসবে যাওয়া মানেই গন্ডগোলে পরা।
লিচু একটু চুপ করে বলে, আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে।
না রে লিচু, আমরা সাধারন মানুষ আমাদের মিটিং মিছিলে যাওয়া ঠিক না। হয়ত হঠাৎ করে মারামারি লেগে যাবে, কি কেউ তোকে গুলি মেরে দিবে।
মা তুমি সব সময় ভয় পাও আর খালি বাজে চিন্তা কর। কত হাজার হাজার লোক যাবে এই মিটিং এ জান। সারা দেশের লোক যাবে। লিচু খাওয়া বন্ধ করে কথা বলতে থাকে।
ওহ আমি বাজে চিন্তা করি। কি হল আমাদের ওখানে দেখ, কোন কিছুই না, তবু জান হাতে করে পালিয়ে আসতে হল। আরে বাবা সময়টা ভাল না। সবাই উত্তেজিত হয়ে আছে কিছু একটা হয়েই যাবে।
বড় মামাও তো ঢাকা যাবে।
খবরটা নতুন নূরীর কাছে। তার বড়ভাই রাজনীতিতে জড়িয়ে পরছে, এবং আম্মার সায় আছে, কিছুক্ষণ আগেই শুনেছে। যে আম্মা চিরদিন আব্বার রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। তার কাছে কেমন সব অচেনা মনে হচ্ছে। আচ্ছা শেষ কবে সে গ্রামে এসেছিল? বছর দুয়েক হয়ে গেছে, এর মধ্য এত পরিবর্তন হবে কে ভেবেছিল!
মা তুমি খালি ভয় পাও, দেখ নানি একদম ভয় পায় না।তোমার এত কিসের ভয়?
থাক তোকে এত মাতব্বরি করতে হবে না। আমার মতন যখন তোর বয়স হবে, তখন তুইও ভয় পাবি সব কিছুতে।
লিচু গোঁ ধরে বলে নানি তো তোমার চেয়ে বয়সে বড়, উনি তো সাহস পান। তুমি পাও না কেন?
নূরী আর থাকতে পারল না। শোন তোর নানির চার চারটা ছেলে, দুই মেয়ে!সুতরাং তার সাহস হবেই, আমার মতন এক ছেলের মা না! আর বেশি কথা না বলে খেয়ে নে।
বাইরের বারান্দায় হৈ চৈ শোনা যায়। লিচুর খালা ঘরে ঢুকল। ঢিপ করে নূরীর পায়ে সালাম করে। আপা তুমি কেমন আছ! কখন থেকে আসব আসব করছি সময় করতে পারছি না। দুলাভাই কই? এই লিচু কেমন আছিস? এক সাথে সব প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই লিচুর পাশে প্লেট নিয়ে বসে যায়। বাহ্ আম্মা দেখি তোমাদের জন্য একবারে এলাহি আয়োজন করেছে। এই নয়ন, দে তরকারির বাটিটা আমাকে দে।
নূরী তরকারির বাটি থেকে মাংস উঠিয়ে দেয়। তার কত আদরের ছোটবোন। অথচ এমন বিয়ে করল যে সব আদর ভুলে গেল। কি যে বিজুর পছন্দ! নূরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে একটু বেশি করে পোলাউ উঠিয়ে দেয় বিজুর পাতে। আহা কাজ করে করে বিজুর চেহারায় কালশিটে পরে গেছে। বোনের দুরবস্হার জন্য সব রাগ গিয়ে পরে লতিফের উপর। এত বড় সংসার। দুই মেয়ে তিন ছেলে।মেয়ে দুটোকে নিয়ে বিজু আর লতিফ ঢাকায় থাকে। নয়ন জাভেদের ওখানে কাজে ঢুকে গেছে।বড় দুই ছেলে গ্রামে লতিফের বাবামায়ের কাছে থাকে, এখানেই মিলে কাজ করে। তার এত আদরের বোন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে পুরো পরিবারটাকে উলটপালট করে দিয়েছিল। দুবোন যখন হাইস্কুলে পড়ে, তখনই বিজু পালিয়ে যায়। লতিফকে গ্রামে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলতে দেখেছে, জানত না বিজুর সাথে মন দেয়া নেয়ার কথা। যখন জানলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।লজ্জায় তালুকদার সাহেবের মাথা হেঁট হয়ে যায়। উনি গ্রামের বাস উঠিয়ে দিয়ে শহরে চলে যান। বড়বোনের আগেই ছোটবোনের বিয়ে হওয়াকে লোকজন ভালভাবে নেয়নি। যখন নূরীর জন্য পাত্র খোঁজা শুরূ হল তখন ব্যপারটা চরম ভাবে সবাই উপলব্ধি করে। ভাল পরিবারের যোগ্য ছেলের সাথে বিয়ের পাত্র যোগাড়ে ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়ার পর,হঠাৎ করেই জাভেদের খোঁজ পাওয়া যায়। একই গ্রামের ছেলে, শহরে হোস্টেলে থেকে কলেজে বিএ পড়ছে।
তালুকদার সাহেব হাতে চাঁদ পেলেন। দেরি না করে উনি নূরীর বিয়ে দিলেন।খুবই সাধারন কৃষক পরিবারের ছেলে জাভেদ। বংশের মধ্য সেই প্রথম পড়াশোনা করছে। নূরীকে দেখে সে খুবই পছন্দ করে। তার বাবা মাও কোন আপত্তি করেন নাই। সে সব দিনের কথা মনে করে নূরীর আবার দীর্ঘশ্বাস পরে। কুড়িটা বছর হয়ে গেল। বিয়ের পরের বছরই লিচুর জন্ম হল। আস্তে আস্তে নূরী সংসার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এখানে তো সে আসে বেড়াতে, নিজের বাড়ি তার শহরেই। হঠাৎ করে মনে হয় জীবনটা অন্যরকমও তো হতে পারত! হয়ত স্বামী বড় সরকারী চাকুরিজীবি হত, ঢাকা শহরে কি বিদেশে থাকত। অনেক অনেক দিন পরে গ্রামে আসত! কি আবোল তাবোল ভাবছে, হাসি পায় নূরীর, এখনই সে কি প্রতিমাসে গ্রামে আসতে পারে! কি যে হল আজ তার, সব উল্টা পাল্টা চিন্তাভাবনা করছে। মনকে শাসন করে নূরী।
No comments